সাইবার নিরাপত্তা: অনলাইন বিশ্বে সুরক্ষিত থাকার নির্দেশনা
ডিজিটাল যুগে সুবিধার পাশাপাশি ঝুঁকিও অনেক। সাইবার অপরাধ সম্পর্কে জানুন, সতর্ক থাকুন এবং আপনার ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখুন।
সাইবার ক্রাইম কী এবং এর বিস্তার
সাইবার ক্রাইম কোনো আলাদা ধরনের অপরাধ নয়। বাস্তব জগতে সংঘটিত সব ধরনের অপরাধই এখন সাইবার স্পেসের মাধ্যমে হচ্ছে – যেমন খুন, অপহরণ, জালিয়াতি এবং ষড়যন্ত্র। সাইবার অপরাধের জাল অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর পেছনে রয়েছে সুসংগঠিত চক্র, যারা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করছে।
ব্যাপকতা
ভারতে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি সাইবার ক্রাইম হয়। গত বছর সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার সাইবার ক্রাইম হয়েছিল।
অপরাধীদের কৌশল
সাইবার অপরাধীরা প্রযুক্তিগত হ্যাকিংয়ের চেয়েও সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা মনস্তাত্ত্বিক কৌশলের উপর বেশি নির্ভর করে। তারা আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ করে ভুল পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে।
আপনার ব্যক্তিগত ডেটা এবং এর গুরুত্ব
ডেটার মূল্য
আপনার মোবাইল আইডি, ইমেল আইডি থেকে শুরু করে আপনার সম্পর্ক, অভ্যাস, যাতায়াতের স্থান – সবকিছুই ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স (OSINT) এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা যায়। এই ডেটা অত্যন্ত মূল্যবান এবং একবার ইন্টারনেটে চলে গেলে তা সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব।
স্মার্ট ডিভাইসের নজরদারি
আপনার ফোন, অ্যালেক্সা, স্মার্টওয়াচ ২৪ ঘন্টা আপনাকে শুনতে পারে এবং আপনার গতিবিধি রেকর্ড করতে পারে। এমনকি সিসিটিভি ক্যামেরাও সহজে হ্যাক হতে পারে, কারণ অনেকে ডিফল্ট পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে না।
আইনগত সুরক্ষা (DPDP Act)
ভারতে ডেটা প্রোটেকশন বিল পাশ হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, যদি আপনার ব্যক্তিগত ডেটা ফাঁস হয়, তাহলে যে প্রতিষ্ঠান থেকে ফাঁস হয়েছে, তার উপর ২৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
ডার্ক ওয়েব: ইন্টারনেটের অন্ধকার দিক
ডার্ক ওয়েব হলো ইন্টারনেটের একটি লুকানো অংশ, যা সাধারণ সার্চ ইঞ্জিন দ্বারা অ্যাক্সেস করা যায় না। এটি অপরাধীদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে নাম প্রকাশ না করে কার্যকলাপ চালানো যায়।
বিপজ্জনক বিষয়বস্তু
ডার্ক ওয়েবের ৭০% কন্টেন্ট হলো চাইল্ড পর্নোগ্রাফি। এখানে অস্ত্র, মাদকদ্রব্য, ভাড়াটে খুনী এবং অন্যান্য জঘন্য অপরাধের কার্যকলাপ চলে।
প্রবেশের ঝুঁকি
ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং এটি অপ্রস্তুত মনে মারাত্মক মানসিক প্রভাব ফেলতে পারে। এর অবৈধ কন্টেন্ট দেখা বা ডাউনলোড করা আইনত অপরাধ।
প্রচলিত সাইবার জালিয়াতির কৌশল
সেক্সটরশন ও ডিপফেক
আপনার বিকৃত ছবি বা ভিডিও (Deepfake) তৈরি করে তা প্রকাশের হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। এটি বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় সমস্যা।
চাকরি/বিনিয়োগ জালিয়াতি
আন্তর্জাতিক চাকরি বা ক্রিপ্টো বিনিয়োগের লোভ দেখিয়ে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। কোনো লোভনীয় অফার বা সহজে টাকা আয়ের প্রলোভনে পড়বেন না।
সাইবার জালিয়াতি থেকে বাঁচার উপায়
'মোবি আরমার' (MobiArmour) অ্যাপ
এই অ্যাপটি ক্ষতিকারক লিঙ্ক, অনিরাপদ অ্যাপ বা ওয়াইফাই সনাক্ত করতে পারে এবং ওটিপি চুরি প্রতিরোধে সাহায্য করে। যেকোনো লিঙ্কে ক্লিক করার আগে বা QR কোড স্ক্যান করার আগে এটি ব্যবহার করুন।
সরকারি পোর্টাল ব্যবহার
- sarathi.gov.in: হারানো বা চুরি হওয়া ফোন ব্লক করুন।
- tafcop.sancharsaathi.gov.in: আপনার নামে কতগুলো সিম আছে তা পরীক্ষা করুন।
ব্যাংকিং ও কার্ড সতর্কতা
জালিয়াতি হওয়ার ৩ দিনের মধ্যে ব্যাংককে জানালে ১০০% টাকা ফেরত পাওয়ার নিয়ম আছে। পিন টাইপ করার সময় হাত দিয়ে ঢাকুন এবং POS মেশিন নিজের হাতে নিয়ে ব্যবহার করুন।
হোয়াটসঅ্যাপ (WhatsApp) সুরক্ষা
টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন
অবশ্যই সক্রিয় করুন।
গ্রুপে যুক্ত হওয়ার অনুমতি
সেটিংস থেকে সীমাবদ্ধ করুন।
অটো-ডাউনলোড বন্ধ
ছবি বা ভিডিও অটো-ডাউনলোড বন্ধ করুন।
প্রোফাইল পিকচারের গোপনীয়তা
আপনার কন্টাক্ট লিস্টে সীমাবদ্ধ করুন।
সাইবার ক্রাইম ঘটলে অবিলম্বে যা করবেন
জালিয়াতির শিকার হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রথম ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ধাপ ১: ১৯৩০ নম্বরে কল করুন
এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ২৪ ঘন্টার হেল্পলাইন। আপনার লেনদেন আইডি (Transaction ID) এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ দিয়ে কল করুন। তারা ৪৮ ঘন্টার জন্য সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করতে পারে।
ধাপ ২: অনলাইনে অভিযোগ করুন
www.cybercrime.gov.in পোর্টালে অনলাইনে অভিযোগ নথিভুক্ত করুন। আপনার অভিযোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিকটস্থ থানায় চলে যাবে।
ধাপ ৩: ব্যাংককে জানান
অবিলম্বে আপনার ব্যাংককে ইমেল করুন এবং সম্পর্ক ব্যবস্থাপককে (Relationship Manager) দ্রুত টাকা যাওয়া অ্যাকাউন্টটি ফ্রিজ করতে বলুন।